সোহেল রানা মাসুদ। ক্রাইম এডিশন।
টাঙ্গাইলের মধুপুরে ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মাত্র ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের চার মাসের শিশুপুত্রকে বিক্রি করে দিয়েছেন এক মা। এই চাঞ্চল্যকর ও বেদনাদায়ক ঘটনার পরপরই পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে শিশুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটে মধুপুর পৌর শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুন্ডুরা সেওড়াতলা এলাকায়। অভিযুক্ত মা লাবনী আক্তার লিজা স্বামী রবিউল ইসলামের সঙ্গে পারিবারিক কলহের জেরে সন্তান বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয়রা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে আসছিল। সন্তান জন্মের পর সেই সমস্যা আরও বাড়ে। একপর্যায়ে লাবনী আক্তার ছেলে তামিমকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বোনের বাড়ি চলে যান।
সেখানে গিয়ে তিনি এক মনির নামের ব্যক্তির সহায়তায় শিশুকে বিক্রির পরিকল্পনা করেন। পরে ১০ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার এক ব্যক্তির কাছে চার মাস বয়সী তামিমকে বিক্রি করে দেন। বিক্রির টাকায় তিনি নিজের জন্য মোবাইল ফোন, গয়না এবং এক জোড়া জুতা কিনেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন।
স্বামী রবিউল ইসলাম জানান, “আমার ছেলের জন্মের পর থেকেই সংসারে অশান্তি চলছিল। লাবনী হঠাৎ করেই বোনের বাড়িতে চলে যায়। কিছুদিন পর আমি জানতে পারি যে আমার সন্তানকে সে বিক্রি করেছে। পরে কৌশলে তাকে বাড়িতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে স্বীকার করে।”
এরপর রবিউল ইসলাম বিষয়টি মধুপুর থানায় জানালে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। পুলিশি অভিযান চালিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয় এবং শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সকালে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। শিশুর ফিরে আসায় পরিবারের সদস্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মায়ের এমন কর্মকাণ্ডে বিস্মিত।
মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, “আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিই। অভিযুক্ত মা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, তিনি মানসিক চাপে ছিলেন এবং পারিবারিক অশান্তির কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করছি এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এদিকে, শিশুকে যিনি কিনেছিলেন সেই সিরাজগঞ্জের ব্যক্তিকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, শিশু ক্রয়-বিক্রয় একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, যা শিশু অধিকার আইন ও মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের আওতায় পড়ে। অভিযুক্ত মায়ের বিরুদ্ধে মানবপাচার চেষ্টার অভিযোগ আনা হতে পারে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে এই ঘটনা ঘিরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, “একজন মা কীভাবে নিজের বুকের ধনকে এভাবে বিক্রি করতে পারে! এটা শুধু পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যই লজ্জাজনক।”
এ ঘটনায় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং শিশু অধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অনেকেই দাবি করেছেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেজন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, পারিবারিক কাউন্সেলিং ও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়—গৃহস্থালি সমস্যা বা মানসিক চাপে মানুষ কতটা অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক সব স্তরে আরও সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন।
Leave a Reply