সোহেল রানা মাসুদ | ক্রাইম এডিশন | ৭ মে ২০২৫
গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। একটি রাষ্ট্রের সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। অনেক সময় তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে বাধা, হয়রানি, হুমকি, এমনকি জীবননাশের ঝুঁকিতেও পড়তে হয়।
সাংবাদিকতা পেশাটি শুধুমাত্র খবর পরিবেশন বা তথ্য সরবরাহের কাজ নয়। এটি সমাজের দর্পণ হয়ে কাজ করে, যেখানে সত্য তুলে ধরা হয় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক সমাজের চোখ ও বিবেকের প্রতিনিধি। তাঁর কলমের শক্তি অনেক সময় আদালতের রায় কিংবা সংসদের নীতিনির্ধারণের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে—যদি সে কলম সত্যের পক্ষে চলে।
বাংলাদেশে কিছুসংখ্যক সাংবাদিক নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করলেও বাস্তবতা হলো, তাঁদের বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক চাপ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হুমকি, কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কঠোর আইন-কানুনের মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তথ্য প্রকাশের পর অনেক সাংবাদিককে গ্রেফতার, রিমান্ড কিংবা জেল পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তিকে বিপন্ন করে না, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার পরিবেশকেও সংকুচিত করে তোলে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার এই সমস্যাগুলো আলোচিত হলেও বাস্তবিক কোনো কার্যকর সমাধান এখনও আসেনি। সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, পেশাগত স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখানো এখন সময়ের দাবি।
আমরা এমন একটি সমাজ গঠন করতে চাই যেখানে সাংবাদিকরা ভয় বা চাপের মধ্যে না থেকে স্বাধীনভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেন, সত্য প্রকাশ করতে পারেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন একটি তথ্যনির্ভর, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ পায়—সেই লক্ষ্যেই আজ সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্র ও জনগণের সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অত্যন্ত জরুরি:
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দমনমূলক আইন প্রয়োগ বন্ধ করা,
গণমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস করে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা,
পেশাগত প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সহায়তা বৃদ্ধি করা,
এবং যারা সত্য প্রকাশের দায়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম একটি জাতির বিবেক। আর এই বিবেককে স্তব্ধ করে দিলে জাতি অন্ধকারে পথ চলতে বাধ্য হয়। কাজেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতা মানে শুধু পেশার অধিকার নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের সুরক্ষা বলয়। তাই আমাদের সকলের উচিত—সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষা করা, সত্য বলার সাহসকে সম্মান জানানো, এবং গণমাধ্যমকে তার প্রকৃত শক্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।