ক্রাইম এডিশন ডেস্ক | ৮ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের প্রায় নয় মাস পর দেশের রাজনীতি থেকে একরকম নীরবেই বিদায় নিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বুধবার গভীর রাতে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা হন।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ৭ মে রাত ১১টার দিকে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে তার সঙ্গে ছিলেন তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সদস্য এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী। দীর্ঘ সময় ধরে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থান করার পর রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের টিজি ৩৪০ ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ছাড়েন। এ সময় তার মুখে ছিলো নিরবতা, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও তার পাসপোর্টে বিশেষ কোন মন্তব্য বা নিষেধাজ্ঞার সিল দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে একটি কূটনৈতিক সূত্র।
সাবেক এই রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের পেছনে যে কারণ রয়েছে, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিশোরগঞ্জ সদর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তথ্য সামনে আসার পর দেশ ছাড়ার ঘটনাকে অনেকেই নতুন মোড় বলে মনে করছেন।
সূত্র জানায়, গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে কিশোরগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বাদী একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। মামলায় শুধু আবদুল হামিদ নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নামও উল্লেখ রয়েছে। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড সংঘটনের ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, এটি একটি ‘প্রতিহিংসামূলক ও ভিত্তিহীন’ মামলা এবং এর কোনো বাস্তবতা নেই। তাঁরা মনে করছেন, বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ হিসেবে এ ধরনের মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
আবদুল হামিদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এর আগে কখনো সরাসরি তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা ছিল না। কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০টির বেশি মামলা হলেও, কোনোটিতেই তার নাম উঠে আসেনি। ফলে হঠাৎ করে তার নাম এভাবে একটি হত্যা মামলায় জড়ানো এবং এরপর রাতারাতি দেশত্যাগ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেনা তৎপরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সক্রিয়তা রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক কর্মকর্তার দেশত্যাগের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ চিকিৎসার অজুহাতে, আবার কেউ কেউ ছুটি কাটানোর কথা বলে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকেই ফিরছেন না।
আবদুল হামিদ ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার প্রথম মেয়াদ ছিল ২০১৩ থেকে ২০১৮ এবং দ্বিতীয় মেয়াদ ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, যিনি ১৯৭০-এর দশক থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং কিশোরগঞ্জ-৪ আসন থেকে বহুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
একসময় আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে তিনি জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন। তার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তার তেমন সক্রিয়তা ছিল না।
রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে এখন প্রশ্ন উঠেছে, সাবেক একজন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে যদি সত্যি হত্যার অভিযোগ থাকে, তবে সেই তদন্ত কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হবে? আবার অনেকে বলছেন, এটি ন্যায্য বিচারের একটি অংশ, যেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এদিকে, আবদুল হামিদের দেশের বাইরে যাত্রাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছেন, এটি “একটি কৌশলগত পলায়ন”, কেউ বলছেন “চিকিৎসা ও পারিবারিক সফর।” তবে সরকারপক্ষ এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেয়নি।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে যারা মামলার অন্যান্য আসামি হিসেবে নামযুক্ত, তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আগামী দিনগুলোতে এই মামলা এবং আবদুল হামিদের অবস্থান নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কী প্রভাব পড়ে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।