ক্রাইম এডিশন ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯ মে ২০২৫
চট্টগ্রামের রাউজানে আট বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ‘ক্লুলেস’ হত্যাকাণ্ডের অবশেষে জট খুলেছে। ২০১৭ সালে এক সকালে স্থানীয় লোকজন একটি পুকুরে ভেসে থাকা মোটা কম্বলে মোড়ানো একটি অজ্ঞাত লাশ দেখতে পান। পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে, তবে পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় তদন্ত অচিরেই থেমে যায়। মামলা খোলা হলেও, প্রমাণের অভাবে তা কেবল একটি অজানা মৃত্যুর ঘটনার ফাইল হয়েই পড়ে থাকে।
কিন্তু দীর্ঘ আট বছর পর, আধুনিক ফরেনসিক প্রযুক্তি এবং পুলিশি গোয়েন্দা দক্ষতায় খুনের রহস্য অবশেষে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও সিআইডির যৌথ তদন্তে জানা গেছে—নিহত ব্যক্তির নাম নাজিম উদ্দিন। তিনি বিদেশে কর্মরত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর এতদিন কারও জানা ছিল না।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সে সময় স্ত্রী নাছিমা আক্তারের সঙ্গে তার দাম্পত্য কলহ তীব্র আকার ধারণ করে। প্রতিবেশীদের ভাষ্যমতে, পারিবারিক অশান্তি প্রায় নিয়মিত ছিল, তবে তারা কখনও কল্পনা করেননি এটি এমন ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাবে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, নাছিমা আক্তার জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, এক রাতে ঝগড়ার সময় হঠাৎ রাগের বশে তিনি স্বামীকে ধাক্কা দেন, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়। এরপর হতভম্ব নাছিমা মরদেহ লুকানোর পরিকল্পনা করেন। প্রথমেই স্বামীর পাসপোর্ট, নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেন তিনি। তারপর একটি মোটা কম্বলে মরদেহ মুড়িয়ে গভীর রাতে পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেন। বাড়ির মেয়েদের বলে দেন—“তোমাদের বাবা আবার বিদেশ চলে গেছে।”
এ ঘটনায় শুধু নাছিমা নয়, তার ভাই ও এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও তাকে সহায়তা করেন বলে স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে। এদের সবাইকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই রহস্য উদঘাটনে ডিএনএ বিশ্লেষণ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। একসময় পুকুর থেকে উদ্ধার করা হাড়, চুল ও বস্ত্রাংশ সংরক্ষিত থাকায় পরে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি নিহতের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ডিএনএ নমুনা দিতে রাজি হওয়ায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর সন্দেহের তীর যায় নাছিমার দিকে।
নাছিমা আক্তারের কথায় ও কার্যকলাপে গরমিল পেয়ে পুলিশ তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে খুনের কথা স্বীকার করে সে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, পুলিশ মৃতদেহ ফেলার স্থানের কাছ থেকে আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করে, যা মামলাটির গতিকে আরও মজবুত করে।
সিআইডি এই মামলাটিকে ‘একটি ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের বিস্ময়কর সমাধান’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সংস্থাটির উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাফর ইকবাল বলেন, “প্রথমে কিছুই জানা ছিল না। পরিচয়বিহীন লাশ, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, এমনকি নিখোঁজ ডায়েরিও ছিল না। তাই আমাদের কাছে এটি একেবারেই জটিল একটি মামলা ছিল। তবে আমরা হাল ছাড়িনি।”
এই হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত নাছিমা আক্তারকে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তার সঙ্গে অভিযুক্ত অপর দুইজনকে সহায়ক হিসেবে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, নাছিমা খুবই শান্ত ও নম্র স্বভাবের বলে পরিচিত ছিলেন। ফলে এমন অপরাধে তার সম্পৃক্ততা অনেকের কাছেই ছিল অকল্পনীয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চলমান মানসিক দূরত্ব এবং পারিবারিক অশান্তি এই চূড়ান্ত ঘটনার দিকে ঠেলে দেয় বলে মনে করছে পুলিশ।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, যতই সময় পেরিয়ে যাক, অপরাধ গোপন থাকে না। ডিএনএ বিশ্লেষণ ও তদন্ত প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আজ বহু পুরোনো মামলার জট খুলছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে।