নিজস্ব প্রতিবেদক।
ঢাকা শহরে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যায়। অফিসগামী মানুষ থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিক্ষার্থী, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স কিংবা সাধারণ যানবাহন—সবারই চলাচল হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জনজীবন।
প্রতিবার বর্ষা মৌসুমে এমন চিত্র নতুন নয়, তবে আশার কথা হচ্ছে—সিটি করপোরেশন ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা গত কয়েক বছরে খাল ও ড্রেন উন্নয়নে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। একটানা কয়েক ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিই রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার নড়বড়ে অবস্থা প্রকাশ করে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, খাল-নর্দমা পরিষ্কারের কাজ নিয়মিত হয় না। কোথাও কোথাও খালের মুখে ময়লা-আবর্জনা জমে পানি চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক এলাকা আবার দিনভর জলাবদ্ধ থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখল-ভরাট হয়ে যাওয়া খাল, অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং সমন্বয়হীনতা। পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, “শুধু খাল খনন বা ড্রেন নির্মাণ করলেই হবে না। নিয়মিত পরিচর্যা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব সংস্থা এই খাতের দায়িত্বে আছে, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হলেও, সমন্বিত কোনো পরিকল্পনার অভাবে এটি আরও জটিল হয়ে উঠছে।”
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে আগেই খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু এ উদ্যোগ কতটা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে নগরবাসীর মধ্যে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সময়কালে দুই সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে খাল পুনর্খনন, ড্রেন নির্মাণ, পাম্প বসানো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এসব উদ্যোগের সুফল নগরবাসী খুব কমই পাচ্ছেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ছাড়া খালগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সঙ্গে খালের সংযোগ স্থাপন, দখলমুক্ত রাখা ও নিয়মিত সাফাই নিশ্চিত করতে হবে।
জলাবদ্ধতার কারণে একদিকে যেমন যানজট বাড়ছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। জমে থাকা পানিতে মশা ও জীবাণুর বিস্তার ঘটছে, যার প্রভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু ও পানিবাহিত রোগ।
নগরবাসী এখন জানতে চায়—এই বিপুল বাজেট ও প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও কেন প্রতিবছর একই দুর্ভোগ পোহাতে হয়? কারা দায়ী এই ব্যর্থতার জন্য? এবং সেই দায় কি কেউ নিচ্ছে?
সমাধান যত দ্রুত হবে, ততই স্বস্তি ফিরবে ঢাকাবাসীর জীবনে। নইলে বর্ষা মানেই যে দুর্ভোগ—সে সত্যই থেকে যাবে প্রতি বছরকার নিয়তি হিসেবে।