সোহেল রানা মাসুদ। ক্রাইম এডিশন ডেস্ক। ২ জুন ২০২৫
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলমান। সময়ের সাথে তালিকার পরিমাণ বহুগুণে বাড়লেও সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে এই তালিকায় বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি হিসেবে, বর্তমানে দেশে মোট ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন, অথচ ১৯৯৪ সালের তালিকায় এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৬ হাজার। ফলে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এতটা বেড়ে গেল?
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ও ভাতার হিসাব
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে অন্তত ৯০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া পরিচয়ে বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। এদের প্রত্যেকেই বছরে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা করে ভাতা নিচ্ছেন। হিসাব অনুযায়ী, এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে প্রতিবছর সরকারের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে একজন মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা পান। এর পাশাপাশি দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে, ২৬ মার্চে ৫ হাজার এবং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ২ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও খেতাবপ্রাপ্তদের জন্য এই ভাতার পরিমাণ আরও বেশি।
যাচাই-বাছাই শুরু করছে জামুকা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে কুমিল্লা অঞ্চল থেকে। ২ জুন সকাল ১০টা থেকে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই পদক্ষেপকে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করছে জামুকা।
জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, “ঢাকায় বসে কাউকে ভুয়া বা আসল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য মাঠপর্যায়ে গিয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আমরা সরেজমিনে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করব।”
অতীতে বাতিল হওয়া গেজেট ও সনদ
গত ১৫ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৯২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করা হয়েছে। শুধুমাত্র বয়স ১২ বছর ৬ মাসের নিচে হওয়ায় ২ হাজার ১১১ জনের সনদ বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৭১৯টি মামলা মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ঝুলে আছে, যার মধ্যে রয়েছে গেজেট বাতিল, বয়সসীমা সংক্রান্ত সমস্যা, এবং বিভিন্ন ভুয়া দাবি যাচাইয়ের আবেদন।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার আওতায় নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা বর্তমানে ৮৯ হাজার ২৩৫ জন, যা একটি বড় সংখ্যাকে নির্দেশ করে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নতুন উদ্যোগ
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক। দায়িত্ব গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন। তার এই উদ্যোগের ফলে দেশের জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে।
উপসংহার
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত ও সনদ বাতিলের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে যায়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা এবং তথ্যভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ জাতির গর্ব এবং এই ইতিহাসকে বিকৃত করার কোনো সুযোগ সমাজ মেনে নিতে পারে না।