ক্রাইম এডিশন। ডেস্ক রিপোর্ট।
কিছু মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত নয়—তা হয়ে ওঠে একটি সময়ের বিবেক, একটি জাতির বিবেকের প্রশ্ন। ঠিক যেমন সাংবাদিক হাসান মেহেদী। আজও তাঁর মৃত্যু কাঁপিয়ে তোলে বিবেকবান মানুষকে। ১৮ জুলাই ২০২৪—এই দিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রাস্তায় ঝরে যায় একজন সাহসী ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকের রক্ত। কেটে গেছে এক বছর, কিন্তু আজও নেই বিচার।
সেদিন ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল সময়। রাজপথে নামে শিক্ষার্থী, তরুণ, সাধারণ মানুষ। সাংবাদিকরা ছুটে যায় খবর সংগ্রহে—তাদেরই একজন ছিলেন দৈনিক ঢাকা টাইমস-এর সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মেহেদী। সত্যান্বেষী এই সাংবাদিক ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বয়স তখন মাত্র ৩১।
তাঁর এই মৃত্যু শুধু একটি জীবন থামিয়ে দেয়নি—ভেঙে দিয়েছে একটি পরিবার, নাড়িয়ে দিয়েছে সমাজের বিবেক। দুই কন্যাসন্তান ও স্ত্রীকে রেখে তিনি চলে যান—যাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। বড় মেয়েটির বয়স এখন সাড়ে চার বছর, ছোটটির দেড়। তাদের জীবনে বাবার অভাব শুধু আর্থিক নয়—একটি ভালোবাসার আশ্রয়ও হারিয়ে গেছে।
পটুয়াখালীর বাউফল থেকে উঠে আসা এই সাংবাদিক দুর্নীতিবিরোধী রিপোর্টে ছিলেন পরিচিত। দুর্নীতি দমন কমিশন বিটে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতেন। তাঁর লেখায় ছিল স্পষ্টতা, ছিল সাহস। হয়তো সে কলমই কারও কাছে হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর।
মেহেদীর মৃত্যু গভীর আলোড়ন তোলে দেশ-বিদেশে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, সিপিজে, ইউনেস্কো-সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও গণমাধ্যম সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানায়। দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শুরু হয় নতুন করে আলোচনা।
তাঁর মৃত্যু আন্দোলনের শক্তি বাড়ায়। ছাত্রজনতার মনে সাহস জোগায়। তাঁর রক্তের ছাপ রয়ে যায় রাজপথে, হয়ে ওঠে পরিবর্তনের প্রতীক। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সেই দমন-পীড়ন চালানো সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের নতুন যাত্রার পেছনে মেহেদীর আত্মত্যাগ একটি মৌন কিন্তু বলিষ্ঠ অবদান রেখে যায়।
এক বছর পর আজ, সহকর্মীরা বলেন, “হাসান এখনো আমাদের মধ্যে আছেন—তার সততা, সাহস ও দায়িত্ববোধ আমাদের প্রেরণা দেয়।”
তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়—রাষ্ট্র কি দেবে তাঁর রক্তের ন্যায্য মূল্য?
আজও তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো কার্যকর বিচার। বিচারহীনতার এই বাস্তবতা উদ্বেগ ছড়ায় গণমাধ্যমে, সচেতন মহলে।
এদিকে হাসান মেহেদীর পরিবার আজ অসহায়। দুই শিশুকন্যা বাবার আদর না পেয়েই বড় হচ্ছে। স্ত্রী হারিয়েছেন সঙ্গী ও ভরসা। তাই সাংবাদিক সমাজ ও বিবেকবান নাগরিকদের জোরালো দাবি—রাষ্ট্র যেন এই পরিবারের দায়িত্ব নেয়, যেন এ ঘটনা না হয় আরেকটি পরিসংখ্যান মাত্র।
এই মৃত্যু কি শুধুই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা? না কি এটি একটি স্পষ্ট বার্তা—সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুখে দেওয়ার হুমকি?
আজকের দিনে, যখন সত্য উচ্চারণ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তখন হাসান মেহেদীর আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সত্য বলার দায় কঠিন হলেও, তার পতাকা যেন কখনো নিচে না নামে।
Leave a Reply