নিজস্ব প্রতিনিধি, শেরপুর
শেরপুর জেলার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একটি কক্ষে এক চিকিৎসকের রাগান্বিত আচরণের শিকার হন এক রোগী ও তার অভিভাবক। অভিযোগ অনুযায়ী, চিকিৎসক রোগীকে কক্ষে প্রবেশের সময় “আপু” সম্বোধন করার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে রুম থেকে বের করে দেন।
নিয়মিত রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের দায়িত্বে থাকা উচিত শান্ত, সহনশীল এবং রোগীর প্রতি যত্নশীল থাকা। কিন্তু শহরের নয়নী বাজার মহল্লার বাসিন্দা কাজী মাসুম জানান, তার ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মামিয়ার প্রচণ্ড পেট ব্যথা নিয়ে বৃহস্পতিবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দুপুর দুইটার দিকে জেলা সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে উপস্থিত চিকিৎসক তাকে জরুরি কিছু ওষুধের প্রেসক্রিপশন দেন।
কাজী মাসুমের মতে, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী হাসপাতালের ভেতরের স্টক থেকে ওষুধ পাওয়া যায়নি। তাই তিনি বাইরে বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তারা আবারও জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসারের কক্ষে যান। এ সময় আগের চিকিৎসক ডিউটি শেষ করে চলে গেছেন। নতুন দায়িত্বে থাকা ডা. মারজিয়া খাতুনের কাছে তারা প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে, বিশেষ ওষুধ না পাওয়ার তথ্য জানান।
অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা যখন ‘আপু’ সম্বোধন করেন, তখন ডা. মারজিয়া ক্রোধিত হয়ে বলেন, “আমাকে আপু ডাকছেন কেন? আমি মেডিকেল অফিসার। যান, বের হয়ে যান আমার রুম থেকে।” কয়েক দফা ধমক দেওয়ার পর অভিভাবককে রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। হতভম্ব অভিভাবক প্রশ্ন করেন, ‘আপু সম্বোধন করা কি দোষ?’ কিন্তু এতে আরও রাগান্বিত হন চিকিৎসক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাধারণত সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কাউকে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলা যায় তখন যখন সেই ব্যক্তি পরিবারের একজন বা মান্যতা প্রাপ্ত কারো ওপর দায়িত্বশীল অবস্থানে থাকে, যেমন শিক্ষক বা সিনিয়র কর্মচারী। কিন্তু একজন রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসে, তখন চিকিৎসক সেবা প্রদানকারী হিসেবে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে ‘আপু’ সম্বোধন ব্যবহার করা সামাজিকভাবে উপযুক্ত, কারণ রোগী ও তার অভিভাবক এখানে একজন সেবাপ্রদাতা—চিকিৎসক—এর সঙ্গে দেখা করছে। অর্থাৎ চিকিৎসক হলো সেবক এবং রোগী হলো সেবা গ্রহণকারী; তাই স্যার বা ম্যাডাম বলার প্রশ্নও ওঠে না।
এই ঘটনার পর জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মীদের আচরণ নিয়ে উপস্থিত অন্যান্য রোগী ও তাদের অভিভাবকরা সমান অভিযোগ তুলেছেন। তারা জানিয়েছেন, শুধুমাত্র ডা. মারজিয়াই নয়, বরং অধিকাংশ চিকিৎসকই রোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে এমন আচরণ করেন।
স্থানীয় সাংবাদিকরা ঘটনা জানার জন্য বিকেল ৩টার দিকে ডা. মারজিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় তিনি বলেন, “আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারও সঙ্গে কোনো কথা বলব না।” হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাক্তার তাহেরাতুল আশরাফি মুঠোফোনে জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন এবং সম্ভবত ভুলক্রমে এমন কথা বলেছেন। তবে অফিসিয়ালি অভিযোগ বা সরাসরি বক্তব্য পেলে শনিবার আসতে হবে।
জেলা সিভিল সার্জন মুহাম্মদ শাহীন এই ঘটনার প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক। হাসপাতালে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সব পর্যায়ের মানুষ আসবে, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার হওয়া উচিত নয়। আমরা বিষয়টি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে অবহিত করেছি।”
চিকিৎসকের এমন আচরণ শুধুমাত্র রোগী ও অভিভাবককে মানসিকভাবে অসন্তুষ্ট করে না, বরং পুরো হাসপাতালের সেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ করে। স্বাস্থ্যখাত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। এই ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধে হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কড়া করতে হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, রোগী ও তাদের অভিভাবকদের জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা কেন্দ্র। চিকিৎসকরা এই দায়িত্ব পালনের সময় ধৈর্য, সহানুভূতি এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখলে রোগীরা মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করে এবং স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর হয়। অন্যথায়, এমন ঘটনা জনগণের আস্থা কমাতে পারে।
শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মীদের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা, যাতে ভবিষ্যতে রোগী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সদয় ও সম্মানজনক আচরণ বজায় রাখা হয়। জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশা করা যাচ্ছে, এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।