ক্রাইম এডিশন, ডেস্ক রিপোর্ট
২৮ অক্টোবর, ২০২৫ ইং মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন–এর কার্যালয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি–র একটি প্রতিনিধিদল কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৮ দফার সুপারিশ পেশ করেছে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সংগঠনের সেক্রেটারি-জেনারেল সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার-এর নেতৃত্বে সহকারী সেক্রেটারি-জেনারেল এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ (সাবেক এমপি)সহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও মিডিয়া সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব মোঃ সেলিম উদ্দিন।
বৈঠকে জামায়াতে ইসলামি নেতারা অভিব্যক্তি দেন — তারা মনে করেন আগামী সংসদ নির্বাচন যদি সত্যি অর্থে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয়, তাহলে তাদের সুপারিশসমূহ কার্যকর ভাবে বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। নির্বাচন কমিশন ওই পক্ষের দাবিসমূহ মনোযোগসহকারে খোলস পর্যায়ে শোনে এবং বলেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির দাবিসমূহ যৌক্তিক ও বাস্তব-সম্মত” এবং এসব বিষয়ে কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
নিচে জামায়াতে ইসলামির পেশকৃত ওই ১৮ দফার সুপারিশের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলো —
১। প্রথমত, “জুলাই সনদ”–র জন্য আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে, ওই সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আদেশ জারি হোলেই আগামী নভেম্বরে গণভোট আয়োজন করতে হবে।
২। দ্বিতীয়ত, উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সর্বশেষ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’-এর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং অন্য কোনো দলের প্রতীক দেওয়া যাবে না। এটি অটল রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
৩। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার দাবি তুলেছেন সুপারিশকর্তারা।
৪। চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা — যেমন প্রিজাইডিং, পোলিং অফিসার, আনসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী — নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে হবে।
৫। পঞ্চম দফায় সুপারিশ করা হয়েছে, সব ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক সামরিক বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করতে হবে।
৬। ষষ্ঠ দফায় শর্ত দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনী বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৭। সপ্তম দফায় বলা হয়েছে, বিগত অবৈধ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সন্দেহভাজন বা বিতর্কিত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক দায়িত্বগুলো (ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি) একশত ভাগ লটারির ভিত্তিতে দেওয়া হবে।
৮। অষ্টম দফায় সুপারিশ করা হয়েছে, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়োগে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্যানেল থেকে নেওয়া হোক — প্রশাসনের সাধারণ অফিসার ছাড়াও।
৯। নবম দফায় বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে নির্বাচনাধীন এলাকায় সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
১০। দশম দফায় সুপারিশ করা হয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে নির্বাচন-মাঠকে সমতল করা হোক।
১১। একাদশ দফায় বলা হয়েছে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে; এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় আগেই দেওয়া অস্ত্র–লাইসেন্স বাতিল করে তা সরকারের নিকট জমা দিতে হবে।
১২। দ্বাদশ দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী এলাকায় যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
১৩। ত্রয়োদশ দফায় বলা হয়েছে, ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য শুধু ভোটকেন্দ্রের নির্ধারিত এলাকা নয়, এলাকার বাইরের যেকোন স্থানে সন্ত্রাসী তৎপরতা থাকলে তাৎক্ষণিক দমন করা হবে।
১৪। চৌদ্দতম দফায় বলা হয়েছে, ছবিসহ ভোটার তালিকার ছবিগুলো পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না; তাই স্পষ্ট ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং এজেন্টদের আগত সময়ে সরবরাহ করতে হবে।
১৫। পঞ্চদশ দফায় সুপারিশ করা হয়েছে, নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত পোলিং, প্রিজাইডিং অফিসার, আনসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ দেওয়া হোক।
১৬। ষোল শত বাদে দফায় বলা হয়েছে, প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের নিয়ম সহজ করতে ভোটার আইডি কার্ড অথবা পাসপোর্ট যেকোন একটি দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হোক। রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দেওয়া হোক।
১৭। সপ্তদশ দফায় সুপারিশ করা হয়েছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও নিরপেক্ষতা যাচাই করা হোক।
১৮। অষ্টাদশ দফায় বলা হয়েছে, ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসনের আমলে সুবিধা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছিল; তাই সেই অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্রগুলো ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনের এক কর্তা জানান, জামায়াতে ইসলামির পেশ করা এই সুপারিশগুলো কার্যকর করার বিষয়টি তারা মনোযোগসহকারে দেখবেন এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিনিধিদল জানান, তারা আশা করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন-এর আগে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে নির্বাচনের পরিবেশ হবে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য।
তিনি বলেন, “আমরা নির্বাচন কমিশনকে বৃহত্তর দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বলেছি যাতে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে আসতে পারেন, এবং নির্বাচনী মাঠে দলীয় প্রতীক-ব্যবহার, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান-সহ পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়।”
আইনের একটি অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব প্রতীক ব্যবহারের নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও দলীয় প্রতিনিধিদল উল্লেখ করেছে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও পোস্টাল ব্যালট ব্যবহারের সুযোগ, প্রবাসী ভোটারদের ভোটদানের সুবিধা — এগুলো ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ন বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা বলেন, “দাবিগুলো যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য। তবে সব সুপারিশ একযোগে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সহজ নয়; তাই ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে, প্রয়োজনে আইন সংশোধন বা নতুন নির্দেশনা জারি করাও হতে পারে।”
এর আগে জামায়াতে ইসলামি-র প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশন-এর কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পৌঁছে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের আলোচনায় নির্বাচনের পরিবেশ, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক নিরসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সুপারিশগুলোর মধ্যে নির্বাচন প্রশাসন ও বাহিনীর নিয়োগ-প্রক্রিয়া, স্থল-পরীক্ষণ (ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ) ব্যবস্থা, ভোটার তালিকা ও প্রবাসী ভোটারদের সুবিধা — এসবই এমন দিক যা আগামী নির্বাচনকে আরও বেশি স্বচ্ছ ও উৎসবমুখর করতে সহায়ক হতে পারে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুপারিশগুলোর সফল বাস্তবায়নটি শুধু কমিশনের উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী ও ভোটারদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতাও অপরিহার্য। এছাড়া সুপারিশগুলোর জন্য আইনগত পরিবর্তন বা নতুন নির্দেশিকার প্রয়োজন পড়লে তা সময়মতো করা-হতে হবে।