মোঃ শাহাদাত হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:
চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক দরিদ্র পরিবারের দুই মেয়ের বিসিএস ক্যাডার হওয়া আজ পুরো এলাকায় অনুপ্রেরণার আলো ছড়াচ্ছে। সীমাহীন দারিদ্র্য, অনিশ্চিত দিনযাপন এবং সংগ্রামের বাস্তবতা সামনে রেখেও তাঁদের বাবা–মা কখনোই শিক্ষার পথে বাধা হতে দেননি। কঠিন পরিস্থিতির মাঝেও তাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন—শিক্ষাই পরিবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। সেই বিশ্বাসই আজ সত্যে রূপ নিয়েছে।
সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের দিনমজুর আবদুল হান্নান ও তাঁর স্ত্রী নিজেদের স্বপ্নের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সন্তানের পড়াশোনায়। পাঁচ কাঠা জমির ওপর টিনশেড ঘরে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে তাঁদের প্রতিদিনের জীবন ছিল চরম কষ্টে ভরা। কিন্তু তবুও তাঁরা কখনো মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করেননি। বাবা দিনের পর দিন রোদ–বৃষ্টিতে শ্রম দিয়ে উপার্জিত টাকা ব্যয় করেছেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য। মা ঘর–সংসার সামলানোর পাশাপাশি মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে।
এই পরিবারে তিন মেয়ে ও এক ছেলে। এর মধ্যে দুই মেয়ে—সারমিন খাতুন এবং খাদিজা খাতুন—আজ বিসিএস ক্যাডার। ছোট বোন খাদিজা ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। বড় বোন সারমিন ৪৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে পেয়েছেন পশুসম্পদ ক্যাডার। দুই বোনই মনে করেন, তাঁদের সাফল্যের মূলে রয়েছে মায়ের ত্যাগ আর বাবার সংগ্রাম।
স্থানীয় শিক্ষকেরা জানান, সারমিন ও খাদিজার শিক্ষা অভিযাত্রা সহজ ছিল না। কুপির আলোয় রাত জেগে পড়াশোনা থেকে শুরু করে বইপত্র জোগাড় করা—সবই ছিল চ্যালেঞ্জের। কখনও কেরোসিন তেল না থাকায় তাঁরা প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে বিদ্যুতের আলোয় পড়তেন। তবুও থেমে যাননি।
এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ অর্জন করার পর তাঁদের সামনে খুলে যায় উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্ত। প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি সারমিনের পড়াশোনায় বড় অবলম্বন ছিল। পরে খাদিজাও একই বিভাগে ভর্তি হয়ে বোনের সঙ্গে বৃত্তির টাকায় পড়াশোনার খরচ চালান। একই বিষয় পড়ায় তাঁদের বই–পত্রও ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা হতো।
অবশেষে কঠোর পরিশ্রম এবং লক্ষ্যভেদী প্রস্তুতির ফল মিলেছে। দুই বোনের বিসিএস সাফল্যের পর বাবা–মায়ের আনন্দ আজ বর্ণনাতীত। আবদুল হান্নান আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, “মেয়েরা আমাদের কষ্টের মর্ম বুঝেছে। এখন গ্রামের মানুষ আমাদের সম্মান করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়—এটাই সবচেয়ে বড় সুখ।”
স্থানীয় মানুষ মনে করেন, সারমিন ও খাদিজার সাফল্য গ্রামীণ এলাকার মেয়েদের জন্য নতুন উদাহরণ। প্রমাণ হয়েছে—ইচ্ছাশক্তি, সুযোগ এবং সহায়তা থাকলে দারিদ্র্য কোনো বাধাই নয়।
খাদিজা খাতুন ফোনে বলেন, “আমরা এমন বাবা–মায়ের সন্তান হতে গর্ব করি। বড় বোনের ছায়া না পেলে এ পথ চলা আরও কঠিন হতো।”
এই পরিবারের সংগ্রাম ও সাফল্যের পথচলা আজ অনেকের জন্য আশার বার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।