লালমনিরহাট প্রতিনিধি। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
লালমনিরহাট জেলার ঐতিহ্যবাহী সরকারি করিম উদ্দিন পাবলিক কলেজ বর্তমানে তীব্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ, ওই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক এরশাদুল হক ফৌজদারী মামলায় টানা ১২ দিন কারাগারে আটক থাকার পরও আগস্ট মাসের সম্পূর্ণ বেতন পেয়ে গেছেন। কলেজের অধ্যক্ষ তৈয়বুর রহমান বেতন অবমুক্ত করায় এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই শিক্ষাঙ্গনে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে।
ব্যাংক স্টেটমেন্টে স্পষ্ট প্রমাণ
প্রাপ্ত ব্যাংক স্টেটমেন্ট অনুযায়ী দেখা যায়, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় তারিখে এরশাদুল হকের সরকারি বেতন তার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। তিনি ৩ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ৪ সেপ্টেম্বর ব্যাংক থেকে পুরো অর্থ তুলে নেন। অর্থাৎ, আটক থাকা অবস্থায়ই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার নামে পূর্ণ মাসের বেতন ছাড় হয়েছে। বিষয়টি সামনে আসতেই কলেজ পরিচালনা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
নিয়মবিধি উপেক্ষার অভিযোগ
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা বা শিক্ষক কারাগারে আটক হলে তার বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা উচিত। এছাড়া অধ্যক্ষের দায়িত্ব থাকে ঘটনাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অধ্যক্ষ তৈয়বুর রহমান আটক থাকা অবস্থায় কোনো চিঠি দেননি কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। বরং তিনি নীরবে আগস্ট মাসের সম্পূর্ণ বেতন ছাড় করেছেন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এ ধরনের ঘটনা প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, যদি নিয়ম ভেঙে কারাগারে থাকা শিক্ষক বেতন পান, তবে ভবিষ্যতে অন্য ক্ষেত্রেও একই ধরনের অনিয়ম ঘটতে পারে।
শিক্ষক সমাজে ক্ষোভ
কলেজের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যিনি কারাগারে ছিলেন, তার পূর্ণ বেতন দেওয়া কেবল অনিয়মই নয়, বরং অন্যদের জন্য নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। এতে কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।” তাদের দাবি, অধ্যক্ষের এ সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার পরিপন্থী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা নষ্ট করেছে।
শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেক শিক্ষার্থী প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষকরা যদি আইন মানতে ব্যর্থ হন, তবে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হওয়ার শিক্ষা দেবেন? তাদের মতে, এ ধরনের ঘটনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করে এবং সমাজে নেতিবাচক বার্তা ছড়ায়।
অভিভাবকদের উদ্বেগ
শুধু শিক্ষক বা শিক্ষার্থীই নয়, স্থানীয় অভিভাবকরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা জরুরি। অথচ এখানে অধ্যক্ষের নীরব ভূমিকা এবং নিয়মবিধি মানতে ব্যর্থ হওয়া প্রমাণ করে যে প্রশাসনিক গাফিলতি হয়েছে। তারা অবিলম্বে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।
প্রশাসনিক তদন্তের দাবি
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সুশীল সমাজ মনে করছে, বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করা জরুরি। যদি সত্যিই নিয়ম ভঙ্গ করে বেতন ছাড় করা হয়ে থাকে, তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এ ধরনের অনিয়ম বারবার ঘটতে থাকবে।
অধ্যক্ষের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
অধ্যক্ষ তৈয়বুর রহমানের ভূমিকা নিয়েও তীব্র সমালোচনা চলছে। তিনি কেন নিয়মিত প্রতিবেদন না পাঠিয়ে নীরবভাবে বেতন ছাড় করলেন, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, তিনি চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি বেতন ছাড় করায় তার নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শেষকথা
একজন সরকারি কলেজ প্রভাষক কারাগারে আটক থেকেও পূর্ণ বেতন পাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক ত্রুটি ও অনিয়মের দৃষ্টান্ত। এ ঘটনায় কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবক ও সচেতন মহল পর্যন্ত তীব্র সমালোচনায় মুখর। শিক্ষা খাতের সুশাসন বজায় রাখতে বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নইলে এ ধরনের অনিয়ম শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।