ক্রাইম এডিশন প্রতিবেদক | ৯ মে ২০২৫
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে এক টানা অভিযানের পর শুক্রবার ভোরে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নগরীর দেওভোগ এলাকার ঐতিহাসিক ‘চুনকা কুটির’ বাসভবন থেকে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে তাকে আটক করা হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. হাসিনুজ্জামান জানিয়েছেন, ডা. আইভীর বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ মোট ছয়টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত বলে জানায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে চুনকা কুটির ঘেরাও করে পুলিশি অভিযান শুরু হয়। পুলিশ প্রথমে বাসভবনের মূল ফটকে অবস্থান নেয় এবং ঘণ্টাব্যাপী আলোচনার চেষ্টা চালায়।
পুলিশ জানায়, প্রথমে আইভী পুলিশের সঙ্গে যেতে রাজি হননি। তিনি তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। দীর্ঘ আলোচনার পর, ভোরে তিনি পুলিশের সঙ্গে যেতে সম্মত হন। এ সময় তার পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দেওভোগ, মাসদাইর ও জামতলা এলাকার বিভিন্ন মসজিদে মাইকে আইভীর গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে তার শত শত কর্মী-সমর্থক রাস্তায় নেমে আসেন। তারা রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও বাঁশ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করেন। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।
পরে পুলিশের অপরাধ ও অপারেশন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদি ঘটনাস্থলে এসে এলাকাবাসীকে উদ্দেশ করে মাইকিং করেন। তিনি বলেন, “আইভীর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা রয়েছে। আমরা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করছি। কেউ বাধা দিলে সেটি আইন লঙ্ঘনের শামিল হবে এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে আইভীর আইনজীবী ও রাজনৈতিক সহযোগীরা দাবি করেছেন, এসব মামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে দায়ের করা হয়েছে। তারা বলেন, “আইভী একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং নারায়ণগঞ্জবাসীর আস্থা ও ভালবাসার প্রতীক। তাকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।”
ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ছিলেন নারায়ণগঞ্জের প্রথম নারী মেয়র। তিনি পরপর দুই মেয়াদে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালন করেন এবং সুশাসনের প্রতীক হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশংসিত হন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে তার দৃশ্যমান অবদান রয়েছে। তবে গত কয়েক বছরে তার রাজনৈতিক অবস্থান দলের ভেতরেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব তার বিরুদ্ধে অবস্থানকে ত্বরান্বিত করেছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। একাধিক মহল মনে করছে, দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ সংকট ও স্থানীয় আধিপত্যের দ্বন্দ্বই আইভীর ওপর এই চাপের মূল কারণ।
আইভীর গ্রেপ্তারের খবরে নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার মুক্তির দাবিতে হাজারো পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে।
শেষপর্যন্ত পুলিশ তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যায়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে তোলা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আইভীর গ্রেপ্তার শুধু আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়, এটি দেশের চলমান রাজনৈতিক টানাপোড়েনেরও প্রতিচ্ছবি। বিষয়টি আরও বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে এবং সামনের সময়গুলোতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।