সোহেল রানা মাসুদ। ক্রাইম এডিশন। ১০ মে ২০২৫
সাংবাদিকতা একদিকে সমাজের দর্পণ, অন্যদিকে বাস্তবিক অর্থেই এক চরম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। তথ্য প্রকাশ ও সত্য উদঘাটনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত হুমকি, নিপীড়ন, এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশসহ বহু দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে, আর সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
ফরিদুল মোস্তফা: এক নির্যাতিত সাংবাদিকের দীর্ঘ আর্তনাদ
কক্সবাজারের প্রবীণ সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা মামলা, পুলিশি হয়রানি ও সামাজিক নিঃসরণে ভুগছেন। ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও তার ঘুষবাণিজ্য সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে ফরিদুলের জীবনে নেমে আসে অমানবিক অত্যাচারের ছায়া।
২০১৯ সালে তাকে অপহরণ করে পৈশাচিক নির্যাতনের পর ৬টি সাজানো মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। টানা ১১ মাস ৫ দিন জেল খাটার পর জামিনে মুক্ত হলেও আজও মামলা প্রত্যাহার হয়নি। আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও পিবিআই ৬ বছরেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এ এক নিরব বিচারহীনতার করুণ চিত্র।
ফরিদুল মোস্তফা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, তার পাসপোর্ট নবায়ন আটকে আছে, পরিবার অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নিপতিত। বারবার উচ্চ মহলে আবেদন করেও কোনো সুরাহা হয়নি। হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিটও বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এমন অবস্থায় সাংবাদিকতা করা দূরের কথা, পরিবার চালানোই এখন তার জন্য দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচারহীনতা বাড়ায় সাংবাদিক নির্যাতন
সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি এবং আইনি হয়রানি বাড়ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে। সাংবাদিকরা যখন দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর প্রকাশ করেন, তখন তারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও প্রভাবশালী মহলের টার্গেটে পরিণত হন।
এ ছাড়া সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়—খবর সংগ্রহের সময় বাধা, ক্যামেরা ভাঙচুর, এমনকি জীবননাশের হুমকিও এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় সাংবাদিকরা নিজেদের রক্ষার জন্য কোনো আইনি সহায়তা পান না।
এই নির্যাতনের জন্য দায়ী মূল কারণগুলো হলো—
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
আইনের দুর্বল প্রয়োগ
প্রশাসনিক ব্যর্থতা
মিডিয়া হাউজগুলোর প্রতিরোধহীনতা
প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা থেকে যায় নিরাপদে, আর যারা সত্য তুলে ধরেন, তাদের জীবনে নামে অনিশ্চয়তা ও ভয়ের ছায়া।
করণীয় ও আহ্বান
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কঠোর আইন প্রণয়ন, স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সাংবাদিক ইউনিয়ন, যারা প্রয়োজন হলে আদালতে গিয়ে আইনি সহায়তা নিশ্চিত করবে।
সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এ বিষয়ে জোরালো অবস্থান নেয়, তবে সরকারগুলোও বাধ্য হবে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর না হলে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, একটি সমাজে যখন সত্য বলার মানুষরা চুপ করে যায়, তখন ন্যায়বিচারও নির্বাক হয়ে পড়ে।