নিজস্ব সংবাদদাতা, পঞ্চগড়
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. আবুল কাশেমকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ধর্ষণের শিকার এক শিশুর বাবার সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় কথা বলা ও অশালীন আচরণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পার-৩ শাখা সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) ২০২৫ ইং এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, সরকারি চাকরিবিধির পরিপন্থি আচরণ, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং অপেশাদারসুলভ কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর আলোকে তার এ আচরণকে “অসদাচরণ” হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, বরখাস্তের আদেশ জারির সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হবে। তবে নিয়ম অনুযায়ী, বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি খোরপোষ ভাতা পাবেন।
ভাইরাল ভিডিওতে জনরোষ
সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার এক শিশুর বাবার সঙ্গে ডা. আবুল কাশেম অশালীন ভাষায় তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং হুমকিমূলক ভঙ্গিতে কথা বলেন। ভিডিওটি দ্রুত ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের দাবি—এ ধরনের আচরণ চিকিৎসা পেশার মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং চিকিৎসক সমাজের জন্য কলঙ্কজনক।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আজহারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, “চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীর পাশে দাঁড়ানো ও সেবা দেওয়া। কিন্তু এ ঘটনায় দেখা গেছে সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ। একজন ডাক্তারের কাছে সমাজ ধৈর্য ও সহনশীলতা আশা করে, কিন্তু এখানে তা অনুপস্থিত।”
প্রশাসনিক পদক্ষেপ
পঞ্চগড় সিভিল সার্জন ডা. মিজানুর রহমান জানান, বিষয়টি প্রথম নজরে আসার পরই ওই চিকিৎসককে শোকজ করা হয়। পরে মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা রোগীর সেবক, তাই তাদের আচরণ অবশ্যই মানবিক হতে হবে।”
জনমতের প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করেন যে, সরকারি হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা কোনো চিকিৎসকের এমন আচরণ একেবারেই অনভিপ্রেত। একজন চিকিৎসক যদি ভুক্তভোগীর পরিবারের প্রতি সহানুভূতির বদলে অপমানজনক আচরণ করেন, তবে তা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ মন্তব্য করছেন যে, কঠোর শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও বাড়বে। তারা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। চিকিৎসকেরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, তবে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে।
চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ
চিকিৎসা পেশা সমাজে একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে পরিচিত। রোগীর প্রতি সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও ধৈর্যশীলতা একজন চিকিৎসকের সবচেয়ে বড় গুণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু ডা. আবুল কাশেমের আচরণ সেই গুণের সম্পূর্ণ বিপরীত। অনেকেই বলছেন, এই ঘটনায় চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতার সংকট ফুটে উঠেছে।
মানবাধিকারকর্মী রওশন আরা জানান, “ধর্ষণের মতো ট্রমাটিক ঘটনার পর ভুক্তভোগী পরিবার মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ে। চিকিৎসকেরা যদি সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে তাদের আরও আঘাত করেন, তবে তা মানবিকতার পরিপন্থি।”
ভবিষ্যৎ করণীয়
এ ঘটনার পর অনেকেই আশা করছেন, সরকার চিকিৎসক সমাজের নৈতিক মানদণ্ড উন্নত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। প্রশিক্ষণ, মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার মাধ্যমে চিকিৎসকদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি শুধু সাময়িক বরখাস্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এভাবেই পঞ্চগড়ে ধর্ষণ মামলার শিশুর বাবাকে অপমান করার ঘটনায় এক চিকিৎসকের সাময়িক বরখাস্ত দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ঘটনাটি চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতার প্রশ্নে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে।